পাইলস সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় ও ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে আজকের পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পাইলস এর চিকিৎসা ঔষধ খেয়ে দূর করা সম্ভব। তবে পাইলস থেকে চিরতরে মুক্তির উপায় পেতে চাইলে আপনার খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনতে হবে।
পাইলস বা অর্শ রোগ কী?
পায়ুপথ বা পায়খানার রাস্তার মুখ যদি কোনো কারণে ফুলে যায় এবং সেখান থেকে রক্ত পড়ে কিংবা পায়খানার রাস্তায় যদি গোটার মত হয় তখন একে বলা হয় পাইলস। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম হেমোরয়েড। জটিল আকার ধারণ করার আগে অপারেশন ছাড়া অর্শ রোগের চিকিৎসা সম্ভব।
পাইলস এর লক্ষণ – পাইলস হলে কি কি সমস্যা হয়?
পাইলস এর লক্ষণগুলো কী? পাইলস হলে কি কি সমস্যা হয়? এমন প্রশ্নের উত্তর নিচে তুলে ধরা হলো। এসব লক্ষণ দেখা দিলে পাইলস এর চিকিৎসা শুরু করতে পারেন।
১. পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া
পাইলস হলে পায়খানার সাথে উজ্জ্বল লাল বর্ণের অর্থাৎ তাজা রক্ত যেতে পারে। সাধারণত পায়খানার পরে টয়লেট পেপার ব্যবহার করলে সেখানে রক্তের ফোটা লেগে থাকতে পারে। অথবা কমোডে বা প্যানের গায়ে টকটকে লাল রক্তের ছোপ দেখা যেতে পারে।। পাইলস হলে পায়ুপথের মুখে থাকা অ্যানাল কুশনগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্ত বেরিয়ে গিয়ে জমাট বাধার সুযোগ পায় না। এ কারণে এক্ষেত্রে তাজা লাল রঙের রক্ত দেখা যায়।
২. পায়ুপথের মুখের অংশগুলো বেরিয়ে আসা
পাইল হলে সাধারণত মলত্যাগের পরে অ্যানাল কুশনগুলো নরম গোটার মতো বের হয়ে আসে। এগুলো কিছু সময় পর নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে এগুলো আঙ্গুল দিয়ে ভেতরে ঢোকানোর প্রয়োজন হতে পারে। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে পাইলস এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে আঙ্গুল দিয়েও গোটাগুলো ভেতরে ঢোকানো যায় না।
৩. পায়খানার রাস্তায় ব্যথা হওয়া
পাইলস রোগে সাধারণত তীব্র ব্যথা হয় না। তবে যদি পায়ুপথের গোটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে সেগুলো আঙুল দিয়ে ঠেলেও ভেতরে ঢোকানো না যায়, এবং সেগুলোতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অনেক সময় তীক্ষ্ণ বা তীব্র ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত ১-২ দিন স্থায়ী হয়। ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে ঘরোয়া উপায়ে ব্যথার চিকিৎসা করা যায়।
৪. পায়খানার রাস্তায় চুলকানি
পাইলস হলে কখনো কখনো পায়ুপথে বা এর মুখের আশেপাশে চুলকানি হতে পারে। এছাড়া পায়ুপথ দিয়ে মিউকাস বা শ্লেষ্মা-জাতীয় পিচ্ছিল ও আঠালো পদার্থ বের হতে পারে। অনেক সময় মলত্যাগ করে ফেলার পরও বারবার মনে হতে পারে যে পেট পরিষ্কার হয় নি, আবার মলত্যাগ করা প্রয়োজন।
পাইলস থেকে চিরতরে মুক্তির উপায়
রক্ত পড়লে টনক নড়ে। একটু অনিয়ম হলেই ভোগান্তি। বেগ এলেই দুর্ভোগ। মুখ বুজে এই কষ্টকে মেনে নেয় অনেকেই। অজান্তেই রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ওষুধে মোকাবিলা না হলে নিশ্চিন্তে সার্জারি করিয়ে নিন। দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্যে কষ্ট পাচ্ছেন? মলদ্বারে ফোলা ভাব? নিয়মিত রক্ত পড়ে? উপসর্গগুলি অর্শের। প্রাথমিক চিকিৎসার পরও না কমলে বিপদ। অস্বস্তি থেকে বাঁচতে সার্জারি করিয়ে নেওয়া ভাল। মলদ্বারের অ্যানাল ক্যানেলের ভিতরে অথবা বাইরে অর্শ হয়। যার দরুণ রোগীর মলদ্বার থেকে একেবারে টাটকা রক্ত বেরোয়। রক্ত পড়ার সময় সাধারণত ব্যথা হয় না।
পাইলস এর প্রাথমিক চিকিৎসা
পাইলস এর প্রাথমিক চিকিৎসা বলতে কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা রয়েছে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে এই পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করতে পারেন।
বরফ
ঘরোয়া উপায়ে অর্শ নিরাময় করার অন্যতম উপাদান বরফ। বরফ রক্ত চলাচল সচল রাখে এবং ব্যথা দূর করে দেয়। একটি কাপড়ে কয়েক টুকরো বরফ পেঁচিয়ে ব্যথার স্থানে ১০ মিনিট রাখুন। এভাবে দিনে বেশ কয়েকবার বরফ ব্যবহার করলে ভাল ফল পাবেন।
অলিভ অয়েল
প্রতিদিন এক চা চামচ অলিভ অয়েল খান। এটি দেহের প্রদাহ দ্রুত হ্রাস করতে সাহায্য করে। অর্শরোগে নিরাময়ের ক্ষেত্রে এটি খুবই কার্যকরী।
আদা এবং লেবুর রস
ডিহাইড্রেশন অর্শরোগের অন্যতম আরেকটি কারণ। আদাকুচি, লেবু এবং মধু মিশ্রণ দিনে দু’বার খান। এই মিশ্রণ নিয়মিত খেলে অর্শরোগ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ছাড়া দিনে অন্তত ২-৩ লিটার পানি খেলেও অনেকটা উপকার পাওয়া যায়।
অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার
একটি তুলোর বলে অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার লাগিয়ে ব্যথার স্থানে লাগান। শুরুতে এটি জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করবে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর এই জ্বালাপোড়া কমে যাবে। এটি পদ্ধতিটিও দিনে বেশ কয়েকবার অবলম্বন করুন। অভ্যন্তরীণ (ইন্টারনাল) অর্শরোগের জন্য এক চা চামচ অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে দিনে দু’বার খান। এর সঙ্গে এক চা চামচ মধু মিশিয়ে নিতে পারেন।
অ্যালোভেরা
বাহ্যিক (এক্সটারনাল) অর্শরোগের জন্য আক্রান্ত স্থানে অ্যালোভেরা জেল লাগিয়ে ম্যাসাজ করুন। এটি দ্রুত ব্যথা কমিয়ে দিতে সাহায্য করবে। আভ্যন্তরীণ অর্শরোগের ক্ষেত্রে অ্যালোভেরা পাতার কাঁটার অংশ কেটে জেল অংশটুকু একটি প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে ভরে ফ্রিজে রেখে দিন। এ বার এই ঠান্ডা অ্যালোভেরা জেলের টুকরো ক্ষত স্থানে লাগিয়ে রাখুন। এটি জ্বালা, ব্যথা, চুলকানি কমিয়ে দিতে সাহায্য করবে।
পাইলস এর চিকিৎসা কোথায় ভালো হয়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বৃহদন্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. একেএম ফজলুল হক পাইলস রোগের সঠিক চিকিৎসার বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, লেজার সার্জারির মাধ্যমেও ধনন্তরী পাইলস চিকিৎসা হচ্ছে। বিষয়টি মোটেই সত্য নয়। কারণ, এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে লেজারের মাধ্যমে পাইলস চিকিৎসায় কোনো অতিরিক্ত সুবিধা নেই। রিং লাইগেশন এবং লংগো অপারেশনের মাধ্যমে প্রায় ১০০% রোগীর মলদ্বারে কোনো রূপ কাটাছেড়া ছাড়া চিকিৎসা করা সম্ভব।
প্রচলিত অপারেশনে মলদ্বারের তিনটি মাংশ পিন্ড কাটতে হয়। যা আজকাল আমরা শুধু তাদের জন্যই করি যারা রিং লাইগেশন এর জন্য উপযুক্ত নয় এবং লংগো অপারেশন এর যন্ত্র কিনতে অক্ষম।
লেজার দিয়ে পাইলস অপারেশন প্রচলিত অপারেশনের মতই। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে এক্ষেত্রে লেজার বিম দিয়ে কাটা হয় এবং প্রচলিত অপারেশনে সার্জিক্যাল নাইফ দিয়ে কাটা হয়। প্রচলিত অপারেশনের ন্যায় লেজার অপারেশনেও তিনটি ক্ষত স্থান হবে। লেজার অপারেশনের পর সাধারণত অপারেশনের মতই ব্যথা হয়, ঘা শুকাতে ১-২ মাস সময় লাগে। এবং প্রচলিত অপারেশনের মতই একই ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে।
পাইলস চিকিৎসার জন্য বহু ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। যেমন ইনজেকশন, রিংলাইগেশন, ইলেকট্রোকোয়াগুলেশন, আল্ট্রয়েড, ক্রায়োথেরাপি, ইনফ্রারেড ফটোকোয়াগুলেশন, এনাল ডাইলেটেশন, লেজার থেরাপি, প্রচলিত অপারেশন এবং লংগো অপারেশন।
সবধরনের পদ্ধতির মেরিট এবং ডিমেরিট বিবেচনা করলে এবং বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সার্জনদের প্র্যাকটিস বিবেচনা করলে তিনটি পদ্ধতি বেশি প্রচলিত আর তা হচ্ছে রিংলাইগেশন, লংগো অপারেশন ও প্রচলিত অপারেশন। রিংলাইগেশন ও লংগো অপারেশনে মলদ্বারে কোনরূপ কাটাছেড়া ছাড়াই ৯০-৯৫% রোগীর পাইলস রোগের সমাধান সম্ভব।
পাইলস হলে কি কি খাওয়া নিষেধ
পাইলসের সমস্যা প্রাথমিকভাবেই ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। এর সাথে প্রচুর পানি পান করতে হবে। পরিবারের খাদ্যাভ্যাসের উপর নির্ভর করেই বংশের পরবর্তী প্রজন্মেরও পাইলস হয়ে থাকে।
- যেসব খাবারে ফাইবার কম থাকে, সেই খাদ্যগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো। বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ দানা শস্য খেলে বাড়তে পারে সমস্যা।
- দুধ ও পনির বা চিজের মতো দুগ্ধজাত খাবারের পরিমাণ কামালে উপকার মিলতে পারে।
- পাইলস বা অর্শ রোগীদের মাংস খাওয়া উচিত নয়। কারণ বাজারচলতি প্রক্রিয়াজাত মাংস বাড়িয়ে দিতে পারে অর্শের সমস্যা।
- আবার অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবারও ডেকে আনতে পারে নানা সমস্যা। খাবারে অত্যধিক তেল, মসলা ও লবণ পেটের গোলযোগের কারণ হতে পারে।
- ধূমপান ও মদ্যপান বন্ধ করুন।